মা 💖💖💖
আমি ভেবেছিলাম তোমার থেকে কিছুদিনের বিরতি নিলে তুমি হইতো আমার ভাবনার বিষয় গুলো নিয়ে একটু ভাববে। ভাববে যে ,কি হবে তোমার জিবনে আমি না থাকলে, আমি হীনা তুমিটার । বৃষ্টির সময় অফিস যেতে কে বারণ করবে, তোমার অফিসের ফাইল কে গুছিয়ে দেবে, তোমার টিফিন, তোমার রাত্রের রুটি, তোমার ল্যাপটপের চার্জ, তোমার মানিপাস , তোমার পাওয়ার ব্যাংক আরও সব।
না আমি প্রতিবার এর মত এইবার ও ভুল ছিলাম। আজ তুমি তিন মাস পর আমাকে ফোন করলে। অফিস বেরোতে যাবো, তোমার ফোন দেখে মনে হলো, হইতো এই বার সব ঠিক হয়যাবে। কিন্তু ঠিক নয়, তুমি আমায় মুক্তি দিতে ফোন করেছো।
আমার এই চাকরিটা তোমার একদম পছন্দ হয় নি। কিন্তু এই চাকরিটাও কিন্তু তোমার ওই কথার কারণেই ছিল। হঠাৎ সেদিন ঠাসিয়ে থাপ্পড় টা মারার পর, আমায় বললে আমার টাকায় খাস, আমার বাড়িতে থাকিস, আবার আমার মুখে মুখে তর্ক। খুব কষ্ট হযেচ্ছিল। বাবা যে আমায় অশিক্ষিত করে তোমার বাড়ি পাঠায়নি। সারারাত বারান্দায় বসে কেদেছি, তুমি একবারও কাছে আসনি। শেষ এ পরদিন সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হলাম। তুই এখনও যাসনি? কথাটা ঠিক সহ্য হয়নি আমার।
কিন্তু একটা কথা কী জানো, যার কারণে এত ঝগড়া করে এত কিছু হল, খুশির খবর কি জানো সে আসতে চলেছে প্রায় চার মাস আর কিছু মাসের অপেক্ষার পর আমি মা হব, আর তুমি বাবা। না থাক কথা টা তোমায় জনাব না। শুনলাম তুমি নাকি নতুন সংসার এর চেষ্টায় আছো। চাকরিটাও ছাড়বো না। ভালোবাসি বলে এটা নয় যে তোমার সব বেইমানি আমার সহ্য হবে, । না আর একটা বার এর জন্যও নয়। আমি একাই পারবো।
ডিভোর্স পেপারে সাইন করে ঐশী কাঁদতে বসে। ঐশী যেন শুনতে পাই তার ভেতর থেকে কেউ একজন তাকে বলছে, মা আমি লক্ষী, তোমাকে একটুও জ্বালাবো না, তোমার সব কথা শুনে চলবো, এই তোমার ভেতর যে কয়দিন আছি, সেই কইদিন একটু কষ্ট হবে বমি হবে, মাথা ঘুরবে তার পর আবার তুমি আর আমি মিলে নতুন করে সব ঠিক করে নিবো। আমরা একাই পারবো মা। তোমার কষ্ট হলেও চাকরি টা তুমি ছেরও না।
ঐশী একজন আর্কিটেক্ট। যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে আর্কিটেকচার এ এমফিল কমপ্লিট করার পর বাবার পছন্দ করা পাত্র কে বিয়ে করে । বিয়ের আগে চাকরি করত, বিয়ের কিছুদিন যাওয়ার পর শ্বশুরবাড়ির অনিচ্ছায় চাকরি টা আর কন্টিনিউ করা হয়নি। তারপর শুরু হয় মা হওয়ার অধ্যায়। প্রথম দিকে তার স্বামী পাশে থাকলেও শেষ দিকটাই ওই যেনো বেশি করে সব শেষ করে দিল। আজকাল কার যুগে এমন মানুষ পাওয়া যায় তবে।। কিন্তু যারা সব কিছু মেনে নেই তাদের সাথেই মনে হয় ভুল গুলো হয়ে যায়। ঐশীর চোখের জল ও তাই বলছিল বারবার।
বিয়ের আগে ঐশীর একজন ভালো বন্ধু ছিল। ওরা এক কলেজ এই পড়ত। ছেলেটা ওর থেকে 2 বছরের সিনিয়র। শেষ দিকটাই ছেলেটাও যেনো ঐশী কে অগ্রাহ্য করে, অন্য করার হয়ে গেলো। ঐশী ও চুপ চাপ মেনে নিয়েছিল। কী আর করার বা ছিল ঐশির, বন্ধুত্ব তে তো আর প্রতিশ্রুতি ছিল না কোনো। অতঃপর কী আর করার বাবা মা এর পছন্দে বিয়ে করে সংসার। প্রথম দিকে তাজ্জব লাগানো ব্যাপার সেপার। শশুর শাশুড়ী তো সব সময় মাথায় করে রাখে। একটু চাপা স্বভাবের কারণে এই লোক দেখানো ভালোবাসা গুলো বিরক্তির কারণ মনে করলেও ,বাবা মা বলে সব ভালোবেসে নিয়েছিল। তার পর আস্তে আস্তে সেই মা লক্ষী শুরু হলো কুলোনাসি, অলক্ষী, মুখরা। আস্তে আস্তে সংসার এর প্রতি ঘেন্না চলে এসছিল মেয়েটার। যে মেয়েটা রাস্তা দিয়ে হেঁটে গেলে মানুষ দ্বিতীয়বার ফিরে দেখতো, তার চোখের তলে কালি পড়ছে, শরীর মেদ এ পূর্ণ হচ্ছে। কোনো দিকেই খেয়াল নেই যেনো। কেমন যেনো অগোছালো।
আজ প্রায় 14 বছর হতে এলো ঐশীর মেয়ের বয়স্। এখন ওরা দুজনে, মা আর মেয়ে মিলে শ্যামবাজারে একটা ফ্ল্যাট ভাড়ায় থাকে, কিছু দিনের মাথায় একটা নুতন ফ্ল্যাট নিওয়ার কথা চলছে। অনু শ্যামবাজার এভি স্কুলের ক্লাস 8 এর ছাত্রী। বাবার থেকে দূরে থাকলেও বাবার মতো গানের গলা টা পেয়েছে, গান করে খুব সুন্দর। আশেপাশে নানান রকমের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হলে অনুর ডাক পড়ে, বাচ্চা মেয়ে একটু লজ্জা বোধ করলেও মাকে কখনোই অপ্রস্তুতে ফেলেনি।
নতুন ফ্ল্যাটটা শ্যামবাজার মেট্রো স্টেশন থেকে বেরিয়ে খানিকটা গিয়ে সামনেয়। নতুন ফ্ল্যাটে যাওয়ার কিছুদিনের মাথায় খবর পেলো ঐশী ,শুভর ক্যান্সার ধরা পড়েছে। মাথায় ছাদটায় ভেঙ্গে পড়েছিল। এত কষ্ট মনেহয় শুভ কে ছেড়ে আসতেও পায়নি।
সেই পুরোনো বাড়ি, সেই সিড়ি উঠতে পাশের বারান্দায় দোলনা , সব যেমন টা ছেড়ে গেছিলো তেমন ই আছে শুধু ধুলো জমেছে। ফাইনাল ডিভোর্স কমপ্লিট করার পর আর দেখা হয়নি দুজনের । পৃথিবী তে তাদের সন্তান আসতে দেখেও সে দিন মুখ ফিরিয়ে আসতে হয়েছিল শুভ কে। ঐশীর চোখের দিকে তাকানোরও সাহস হয়নি সেদিন। ঐশীও যদি ওটাকে কষ্ট রূপে মেনে নেয়নি। যে নিজে থেকে নিজের ভালো বোঝে না তার আবার কষ্ট কীসের? ওই যে কোথায় একটা পড়েছিলাম, ""যে যত বেশি ভালোবাসে, পারলে সেই পারে প্রতি নিঃশ্বাস এ ঘেন্না করতে। "" ঐশীর ও তাই হয়েছিলো শেষ দিকটায়।
কিন্তু আজ শুভ কে দেখার পর চোখ দুটো লাল হয়ে গেছে। শুভ দ্বিতীয় বিয়ে টাও টিকিয়ে রাখতে পারে নি। এখন ওই বুড়ি মা, শুভ, আর শুভ দেখা সোনা করার জন্যে একটা ওই 32 33 বছরের ছেলে।
শুভ:- ঐশী অনু আসেনি? তুমি দরজায় কেনো? ভেতরে এসো। অনু কে কখনো দেখিনি। মিথ্যে বলবো না একদিন তোমার ফেসবুক স্টক করতে গিয়ে অনুর সব ছবিই দেখলাম। বেশ ভালো আছো বলো তোমরা দুজনে।।
ঘরের ভেতর অনু কে ভেকে ঐশী এলো।
ঐশী:- অনু ভিতরে আয় তোর পাপা তোকে দেখতে চায়ছে। পাপার পাশে গিয়ে বসো।
শুভ:- আয় সোনা আমার কাছে আয়। তুই আর একটু আগে এলে আমার এই দিন আসতো না।
কথা গুলো বলে অনু কে ধরে শুভ চোখ কে শক্ত করে বন্ধ করে ফেলেছে। তার চোখের জল যেনো কোনো মতেই কেউ দেখতে না পায়।
ঐশী:- অনু তুই বাইরে যা তোর পাপর সাথে আমার একটু কথা আছে।
ঐশী:- কেমন আছো শুভ?
শুভ:- যেমন দেখছো। ডাক্তার আর 1 মাসের সময় দিয়েছে। জানি আমার কোনো দাবি করা মানায় না। তবুও যদি এই মাস টা তুমি.....
ঐশী:- না শুভ এই দাবি তুমি কোরো না। এই মাস তোমার কাছে আমরা থাকলে আমি অনু কে সামলে উঠতে পারব না। ও তোমার সাথে থাকলে আর কোনোদিন ও উঠে দাঁড়াতে পারবে না। আমায় তুমি ক্ষমা করো।
বেশ কিছুক্ষন দুজনেই চুপ করে বসে থাকার পর ঐশী এবার উঠে আসতে চাইলো।
ঐশী:- তাহলে তুমি থাকো শুভ আমাকে যেতে হবে, ওদিকে দেখি অনু কোথায় গেলো।
বাইরে এসে দেখে অনু ওর ঠাম্মির সাথে গল্প করছে। নারকেলের নাড়ু, খই এর মুড়কি, আরো কত কি প্লেটে করে সাজিয়ে দিয়ে দুজনে মিলে খুব কথা। কি পড়ছে, গান কোথায় শেখে আরো অনেক কিছু।
গল্প করছে, ডাকবো? মনে মনে ভেবেও, এবার ঐশী কে অনু ডাক দেয়।
ঐশী:- চল বাবু বাড়ি ফিরতে হবে। সন্ধে প্রায় হতে এলো।
শুভর মা:- আমি তোমাকে আটকাতে পারবো না মা। হইতো আমিই আমার ঘরের লক্ষী কে অগ্রাহ্য করে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম। এখন আর কোন মুখে তোমায় থাকতে বলি ।
অনু কথা না বাড়িয়ে মেয়ের হাত ধরে বেরিয়ে আসে। চোক জলে ভরে যায় তবুও"" একবার তাড়িয়ে দিলে সেখানে আর থাকতে নেই ""এটাই মাথায় ঘোরে। যদিও এই ফিরিয়ে নেওয়া টা বছর চোদ্দো আগে হতো তাহলে হইতো পরিস্থিতিটা আলাদা থাকতো।
গাড়িতে উঠে ঐশী পিছন ফিরে দেখে, শুভ সিড়ির বারান্দায় এসে দাড়িয়েছে। আজ আর কিছু করার নেই এই টুকু ভেবে হাও হাও করে কেদে, আবার অনুর মুখের দিকে তাকিয়ে নিজেকে সামলে নেই। ছোট মেয়েটা এত কিছু বুঝবে না।
সময় আমাদের ভুল করতে শেখায়। আবার সময়ই আমাদের ঠিক টাও শেখায়। তাই সময় থাকতে সময়ের কাজ করে নিজেকে শুধরে নেওয়া উচিত । সময় চলে গেলে আর কেউ ফিরে আসে না সময়ের সাথে সাথে। ফুরিয়ে ফেলা জিনিস ফিরে পাওয়া যায় না।
Comments
Post a Comment